কবিতার মাঝে আমি সবার কথাই বলেছি: হেলাল হাফিজ

প্রকাশঃ মার্চ ১৮, ২০১৫ সময়ঃ ৩:৫৮ অপরাহ্ণ.. সর্বশেষ সম্পাদনাঃ ৩:৫৮ অপরাহ্ণ

ডেস্ক রিপোর্ট, প্রতিক্ষণ ডটকম:

helal-hafiz20141015132953তিনি কষ্ট ফেরি করেন। হরেক রঙের কষ্ট। আদতে কষ্ট নয়, তিনি ফেরি করেন হরেক রঙের কবিতা। আশ্চর্য রকম সব কবিতা। বাংলা কবিতার ইতিহাসে হেলাল হাফিজ তাই কবিতার আশ্চর্য এক ফেরিওয়ালা।

কবি হেলাল হাফিজের জন্ম ১৯৪৮ সালের ৭ অক্টোবর, নেত্রকোনা জেলার বড়তলী গ্রামে। শৈশবে মাকে হারিয়েছেন। স্কুল শিক্ষক বাবার কড়া শাসনে কেটেছে শৈশবের দুরন্ত সময়। ছিলেন স্কুলের সেরা খেলোয়াড়।

নেত্রকোনাতেই কেটেছে স্কুল এবং কলেজ জীবন। ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে ভর্তি হন বাংলা বিভাগে। তারপরই কবিতা নামক পোঁকার আক্রমণে আক্রান্ত হয়ে পড়েন।

লেখালেখি শুরু করার ১৭ বছর পর প্রকাশ করেন প্রথম এবং একমাত্র কবিতার বই ‘যে জলে আগুন জ্বলে’। ১৯৮৬ সালের বইমেলায় কবিতার বইটি প্রকাশিত হওয়ার পরই নিজেকে আড়াল করে নেন তিনি। সুদীর্ঘ ২৫ বছর এক ধরনের স্বেচ্ছানির্বাসনের মতো অবস্থা থেকে বের হয়ে ২০১২ সালের বইমেলায় প্রকাশিত হয় তাঁর দ্বিতীয় গ্রন্থ কবিতা একাত্তর। আজ বিশেষ সাক্ষাতকারের অতিথি কবি হেলাল হাফিজ।

প্রশ্ন : কয়েক মাস পরই আপনি পৌঁছুবেন ৬৭তম জন্মদিনে। পেছনে কাটিয়ে এসেছেন জীবনের এতটা বছর। তাই শুরুতেই জানতে চাইছি, ৬৭ বছরের জীবনে ২৫টি বছর কাটিয়ে দিলেন অন্তরালে, আজ এখন এই সময়টাতে আপনার উপলব্ধি কী?

হেলাল হাফিজ : জন্মদিন তো আসলে আনন্দের কোনো বিষয় নয়। বরং এটি এক ধরনের মন্দ লাগার কারণ। ৬৬ বছর পেছনে ফেলে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়া। ৬৬ বছর হয়তো অঙ্কের হিসাবে বেশ দীর্ঘ একটা সময়ই বটে। কিন্তু আমি পুরো সময়টাকে কাজে লাগাতে পারিনি। আর এই জীবন যাপন করতে গিয়ে হয়তো নতুন কোনো কষ্ট আবার বুকে জমেছে। সেগুলো আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে চায়। যে বেদনাবোধ, নিজের স্বপ্ন এবং প্রেম থেকে লেখা হয়েছে আমার ‘যে জলে আগুন জ্বলে’।

আমার অব্যক্ত কথাগুলোই প্রকাশিত হয়েছে কবিতার বইয়ে। আবার হয়তো কিছু বেদনা জমেছে। সেগুলোকে প্রকাশ করতে হবে। আর জীবনের ২৫ বছরেরও বেশি সময় যে স্বেচ্ছা নির্বাসিত ছিলাম তার জন্য আমার কোনো অনুশোচনা নেই। ৬৬ বছর থেকে ২৫টি বছর তো এক ধরনের ঝরে যাওয়াই বলা যেতে পারে। তবে তা নিয়ে কোনো দুঃখবোধ নেই।

প্রশ্ন : এবার আমরা একটু গোড়ার দিকে যেতে চাই। কখন থেকে সিদ্ধান্ত নিলেন যে কেবল কবিতাই লিখবেন?rudra-p

হেলাল হাফিজ : সোজাসুজি বলতে গেলে কলেজ জীবন থেকে। স্কুল জীবনে আমি খুব ভালো খেলোয়াড় ছিলাম। স্কুলের হয়ে বাইরের বিভিন্ন দলের বিপক্ষে বেশ ভালো ফুটবল খেলতাম। এ ছাড়া লং জাম্প ছাড়াও ভলিবলটাও খুব ভালো খেলতে পারতাম। কিন্তু সবকিছুর পরও মাতৃহীনতার একটা শূন্যতা আমাকে তাড়া করত। খেলাধুলা আমাকে সেই হাহাকারময় অবস্থা থেকে পরিত্রাণ দিতে পারত না

। তখনই আমি আশ্রয় নিই কবিতার। আকড়ে ধরি কবিতাকে। কবিতাও আমাকে আশ্রয় দেয়। তারপর ইন্টারমিডিয়েট পাসের পর ৬৭ সালের দিকে যখন ঢাকায় চলে আসি, তখন সবকিছু যেন বদলে গেল।

আর একটি ব্যাপার যেটি আমার মনে হয়, আমাদের যৌবনের সময়ে এই ভূখন্ডে বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে যা আমাদের সময়ের অনেককেই প্রভাবিত করেছে। কিছু ঘটনা যেমন- ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধ, এসব ঘটনাগুলো আমাদের প্রবলভাবে প্রভাবিত করেছে, আলোড়িত করেছে। যা আমাদেরকে কবিতা লিখতে এক ধরনের সহায়তা করেছে বলেই আমার মনে হয়।

প্রশ্ন : আপনার কাব্যগ্রন্থ ‘যে জলে আগুন জ্বলে’র কবিতা বিন্যাসের দিকে তাকালে দেখি যে ৬৯ থেকে ৮৫ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে লেখা কবিতা স্থান পেয়েছে। কাব্যগ্রন্থটিতে মোট ৫৬টি কবিতা রয়েছে। এই সুদীর্ঘ ১৬ বছরে কি আপনি ৫৬টি কবিতাই লিখেছিলেন?

হেলাল হাফিজ : না না। কবিতা জমেছিল প্রায় ১২০টির মতো। সেখান থেকে বাছাই করে ৫৬টি কবিতা নেওয়া হয়েছে। আর কবিতা বাছাইয়ের ক্ষেত্রে আমি চেয়েছি যেন প্রেম, দ্রোহ, সংগ্রাম, দেশ, সমাজ, ব্যক্তিগত প্রেম বা জীবন সবকিছু যেন এক মলাটে বন্দি করা যায়। আর ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ বইটি করার জন্য কবিতা বাছাইয়ে আমি সময় নিয়েছিলাম ছয় মাসের মতো। প্রতিদিন কবিতা বাছাই করতাম। আবার রাতে শুয়ে শুয়ে ভাবতাম এই কবিতাটি বাদ দিয়ে অমুক কবিতাটি নিতে হবে। আবার পরের দিন দেখা যেত আগের রাতের বাছাই করা কবিতাটি বাতিল করে দিতাম।

অনেক সময় এমনও হয়েছে যে, কবিতা বাছাই করতে গিয়ে মনে পড়ত আচ্ছা, ওই যে সদরঘাটের বা গুলিস্তানের মিছিল থেকে আসার পরে যে কবিতাটি লিখেছিলাম সেটি বাদ দেব কেন? নিয়ে নিই না কেন সেটি? আবার দেখা যেত কোনো এক নারীর কথা স্মরণ করে লেখা কোনো একটি কবিতা নেওয়ার জন্য আবার নতুন করে কবিতা বাছাই করেছি। তাই কবিতা নির্বাচন করাটা আমার কাছে অনেক বেশি কঠিন হয়ে পড়েছিল।

প্রশ্ন : ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতা ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’র প্রথম দুটি লাইন আপনাকে রাতারাতি তারকা কবির পরিচিতি এনে দেয়। তখন ৬৯ এবং ৭১ এ আপনার এই কবিতা মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। আপনার কবিতা লেখা থাকত দেয়ালে, দেয়ালে। তারপরে দেশ স্বাধীনেরও অনেককাল পরে ৫৬টি কবিতা একত্রিত করে ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত হলো ‘যে জলে আগুন জ্বলে’। আর এদিকে আমাদের দেশটিও ৫৬ হাজার বর্গমাইল আয়তনের। দেশের ভূখণ্ডের সাথে মিলিয়েই কি ৫৬টি কবিতা রেখেছিলেন?

হেলাল হাফিজ : না। এটা কাকতালীয়। আমি এমন করে ভাবিনি। তুমিই প্রথম যে এই বিষয়ে এভাবে মিলিয়ে দেখলে। আসলে ৫৬টি কবিতা রাখা হয়েছিল বইয়ের ফর্মা অনুযায়ী। এর চেয়ে বেশি কবিতা রাখা যেত না। তাই ৫৬টিই নির্বাচিত করা হয়েছে।

প্রশ্ন : কেবল একটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের পরই কেন নিজেকে আড়ালে নিয়ে গেলেন বা আড়াল করলেন?

হেলাল হাফিজ: নানা কারণে। তবে কিছু মান-অভিমান তো ছিলই। কিন্তু আমি কবিতা নিয়ে কখনোই ব্যবসা করতে চাইনি। কবিতাকে অর্থ উপার্জনের মাধ্যম বলেও কখনো ভাবিনি।

প্রশ্ন : এই যে একটি কাব্যগ্রন্থ দিয়ে প্রায় দুই প্রজন্মকে সমানভাবে সম্মোহিত করে রাখলেন, আপনার কবিতার কোন বিশেষ দিকটির জন্য আপনার কবিতা এখনো শুরু থেকে সমান পঠিত বলে মনে করেন?

হেলাল হাফিজ: আমার কবিতায় মানুষের স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষাকে হয়তো প্রকাশ করতে পেরেছি। আমার স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা মানুষকে স্পর্শ করেছে বলেই এটা হয়েছে বলে মনে হয়। যেমন- এবার এই যে শাহবাগে আন্দোলন হলো, সেখানেও রোজ কেউ না কেউ আমার কোনো না কোনো কবিতা আবৃত্তি করেছে। মানুষ প্রেমে পড়তে গিয়েও আমার কবিতা পড়ছে। প্রেমে মজেও পড়ছে। আবার প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়েও পড়েছে। আমার কবিতার মাঝে যেন একক আমি সবার কথাই বলেছি। তাই হয়তো এমনটা হতে পারে।

**আপিনাকে অনেক ধন্যবাদ।
হেলাল হাফিজ:আপনাকেও ধন্যবাদ।সূত্র:এনটিভি

প্রতিক্ষণ/এডি/আকিদ

আরো সংবাদঃ

মন্তব্য করুনঃ

পাঠকের মন্তব্য



আর্কাইভ

May 2024
S S M T W T F
 123
45678910
11121314151617
18192021222324
25262728293031
20G